,

আবরার হত্যায় ১০ দফায় অনড় শিক্ষার্থীরা ॥ ফের আল্টিমেটাম

সময় ডেস্ক ॥ আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দশ দফা দাবি মেনে নিতে ভিসি অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলামকে গতকাল দুপুর ২টা পর্যন্ত আল্টিমেটাম দেয়া হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে ভিসি সশরীরে এসে দাবি মেনে নেয়ার ঘোষণা না দিলে বিশ্ববিদ্যালয়টির সকল একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম অচল করে দেয়ার হুমকি দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। গত বুধবার চতুর্থ দিনের আন্দোলন শেষে এ ঘোষণা দেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। এর আগে ভিসি আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দিলেও গণমাধ্যমের উপস্থিতিবিহীন কোনো আলোচনায় বসতে রাজি হননি আন্দোলনকারীরা। এদিকে, বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নয়, বরং সংগঠনভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি স্পষ্ট করেছেন শিক্ষার্থীরা। আর নিজেরা কোনো দলীয় রাজনীতি না করার ঘোষণা দিয়ে ভিসি অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলামের পদত্যাগসহ ৭ দফা দাবি দিয়েছে বুয়েট শিক্ষক সমিতি। অন্যদিকে, আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনায় গতকালও বিক্ষোভ ও গণপদযাত্রা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি নুরুল হক নুর সম্প্রতি বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের করা ৭টি চুক্তিকে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী উল্লেখ করে তা বাতিল করার হুঁশিয়ারি দেন। তিনি বলেন, আবরারের রক্ত ঝরানো অসম চুক্তি আমরা বাস্তবায়ন হতে দেবো না। আবরারের হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌন মিছিল করেছে ছাত্রলীগ।
ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে স্বতন্ত্র জোট। গতকাল চতুর্থ দিনের মতো আবরার ফাহাদের হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তিসহ দশ দফা দাবিতে বুয়েট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিক্ষোভ শুরু করেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। এরপর সেখান থেকে তারা বিক্ষোভ মিছিল করে পুনরায় শহীদ মিনারে এসে অবস্থান নেন। এসময় ‘শিক্ষা-সন্ত্রাস, এক সঙ্গে চলে না’, ‘খুনিদের ঠিকানা, এই বুয়েটে হবে না’, ‘এক আবরার কবরে, লক্ষ আবরার বাহিরে’, ‘বহিষ্কার বহিষ্কার, খুনিদের বহিষ্কার’, ‘যাবো না, যাবো না, ফাঁসি ছাড়া যাবো না’ ইত্যাদি স্লোগানে তারা আবরার হত্যার বিচার দাবি করেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সংবাদ সম্মেলন করেন বিক্ষুব্ধরা। এসময় তারা বলেন, হল প্রশাসনের যে ব্যবস্থাগুলো নেয়া উচিত ছিল, তা নেয়া হয়নি। এ ধরনের কোনো প্রক্রিয়াও গ্রহণ করেনি। কাজেই এভাবে চলতে থাকলে আগামী ১৪ই অক্টোবর বুয়েটে যে ভর্তি পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল, তা নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে। শিক্ষার্থীদের দাবিগুলোর মধ্যে এ পর্যন্ত বুয়েটে যত শিক্ষার্থীর ওপর নির্যাতন হয়েছে তার বিচার করতে হবে। গতকাল বাদ আসর বুয়েট কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে ফাহাদের আত্মার মাগফেরাত কামনায় দোয়া মাহফিল করেছে শিক্ষার্থীরা। এর আগে দুপুরে আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা বুয়েটের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী অন্তরা মাধুরী বলেন, ভিসি স্যারকে আমরা মানববন্ধনের মাধ্যমে আসার সুযোগ করে দিয়েছিলাম। তার সঙ্গে আমরা যদি কোনো দুর্ব্যবহার করে থাকি, তার কাছে আমরা ক্ষমা প্রার্থনা করছি। ভিসির প্রতি আহ্বান জানিয়ে অন্তরা বলেন, ‘স্যার, আপনি আসুন, আমরা শুধু কথা বলবো। আপনার প্রতি আমাদের কোনো রাগ নেই।’ অন্তরা বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আমাদের বিষয়গুলোর স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং এগুলো নিয়ে কথা বলেছেন।
উনি আমাদের সবার অভিভাবক, ওনার জন্যই ব্যাপারগুলো এত দ্রুত সুষ্ঠুভাবে হয়ে আসছে। আমরা বিশ্বাস করি, এটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্যই সম্ভব হয়েছে।’ বুয়েটের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শীর্ষ সংশপ্তক বলেন, আমাদের আন্দোলন ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে নয়। আমরাও স্বীকার করে নেই যে, আমাদের দেশের ইতিহাসে ছাত্ররাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু আজকে বুয়েটে যে নষ্ট ছাত্ররাজনীতি হয়েছে, যার জন্য আমরা আসলে বেঁচে থাকতে পারছি না, যার জন্য হলে ও ক্যাম্পাসে প্রতিটি শিক্ষার্থী ত্রাসের মধ্যে থাকে, আমাদের আন্দোলন তার বিরুদ্ধে। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই, কারণ তিনি এ বিষয়টির স্বীকৃতি দিয়েছেন। আমাদের আন্দোলনটি আসলে রাজনীতির বিরুদ্ধে নয়, বরং শুধু বুয়েট ক্যাম্পাসে সংগঠনভিত্তিক ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে। শীর্ষ বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদের দাবির বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন এবং এ বিষয়ে মিডিয়ার সামনে কথা বলেছেন। তিনি এও বলেন, কোনো প্রতিষ্ঠান চাইলে এটি বন্ধ করে দিতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় কোনো প্রভাব থাকবে না। এর জন্য প্রয়োজন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সৎসাহস ও সদিচ্ছা। আশা করবো, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর আমাদের প্রশাসন ও ভিসি এ বিষয়ে পিছিয়ে থাকবেন না। ভিসি স্যার আসবেন, আমাদের সব প্রশ্নের উত্তর দেবেন এবং আমাদের দাবিগুলো মেনে নেবেন।
শিক্ষার্থীদের ১০ দফা দাবির মধ্যে রয়েছে- খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সিসিটিভি ফুটেজ ও জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে শনাক্তকারী খুনিদের প্রত্যেকের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সিসিটিভি ফুটেজ থেকে শনাক্ত করা সবাইকে ১১ই অক্টোবর, ২০১৯ বিকাল পাঁচটার মধ্যে আজীবন বহিষ্কার নিশ্চিত করতে হবে, মামলা চলাকালে সব খরচ এবং আবরারের পরিবারের সব ক্ষতিপূরণ বুয়েট প্রশাসনকে বহন করতে হবে। এ মর্মে অফিশিয়াল নোটিশ ১১ তারিখ পাঁচটার মধ্যে প্রদান করতে হবে; আবরার হত্যায় দায়ের করা মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের অধীনে স্বল্পতম সময়ে নিষ্পত্তি করতে বুয়েট প্রশাসনকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। বুয়েট প্রশাসনকে সক্রিয় থেকে সব প্রক্রিয়া নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং নিয়মিত ছাত্রদের আপডেট করতে হবে, অবিলম্বে চার্জশিটের কপিসহ অফিশিয়াল নোটিশ দিতে হবে, বুয়েটে সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যানারে দীর্ঘদিন ধরে বুয়েট হলে হলে ত্রাসের রাজনীতি কায়েম করে রাখা হয়েছে।
জুনিয়র মোস্ট ব্যাচকে সব সময় ভয়ভীতি প্রদর্শনপূর্বক জোর করে রাজনৈতিক মিটিং-মিছিলে যুক্ত করা হয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে যেকোনো সময় যেকোনো হল থেকে সাধারণ ছাত্রদের জোরপূর্বক হল থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে হলে হলে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। রাজনৈতিক সংগঠনের এমন কর্মকান্ডে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ। তাই আগামী ৭ দিনের মধ্যে (১৫ই অক্টোবর) বুয়েটে সব রাজনৈতিক সংগঠন এবং এর কার্যক্রম স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম কেন ৩০ ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার পরও ঘটনাস্থলে উপস্থিত হননি এবং ৩৮ ঘণ্টা পরে উপস্থিত হয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করেন এবং কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে স্থান ত্যাগ করেন। তাকে সশরীরে ক্যাম্পাসে এসে আগামীকাল বেলা দুইটার মধ্যে জবাবদিহি করতে হবে; আবাসিক হলগুলোতে র?্যাগের নামে ও ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর সব ধরনের শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন বন্ধ করতে হবে এবং এ ধরনের সন্ত্রাসে জড়িত সবার ছাত্রত্ব প্রশাসনকে বাতিল করতে হবে। একই সঙ্গে আহসানউল্লাহ হল এবং সোহরাওয়ার্দী হলের পূর্বের ঘটনাগুলোতে জড়িত সবার ছাত্রত্ব বাতিল ১১ই অক্টোবর, ২০১৯ তারিখ বিকাল পাঁচটার মধ্যে নিশ্চিত করতে হবে, পূর্বের এ ধরনের ঘটনা প্রকাশ এবং পরবর্তী সময়ে ঘটা যেকোনো ঘটনা প্রকাশের জন্য একটা কমন প্ল্যাটফরম, কোনো সাইট বা ফর্ম থাকতে হবে এবং নিয়মিত প্রকাশিত ঘটনা রিভিউ করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচারের ব্যবস্থা নিতে হবে। এই প্ল্যাটফরম হিসেবে বুয়েটের বিআইআইএস অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করতে হবে এবং ১১ই অক্টোবর, ২০১৯ তারিখ বিকাল পাঁচটার মধ্যে দৃশ্যমান অগ্রগতি প্রদর্শন করতে হবে। পরবর্তী ১ তারিখের মধ্যে কার্যক্রম পূর্ণরূপে শুরু করতে হবে। নিরাপত্তার স্বার্থে সব হলের প্রত্যেক ফ্লোরে উইংয়ের দু’পাশে সিসিটিভি ক্যামেরার ব্যবস্থা করতে হবে; রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে আবাসিক হল থেকে ছাত্র উৎখাতের ব্যাপারে অজ্ঞ থাকা এবং ছাত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হওয়ায় শেরেবাংলা হলের প্রভোস্টকে ১১ই অক্টোবর, ২০১৯ তারিখ বিকাল পাঁচটার মধ্যে প্রত্যাহার করতে হবে।


     এই বিভাগের আরো খবর